May 3, 2024, 2:27 pm

কোথাও কি নারী নিরাপদ?  নারীর নিরাপত্তা এবং কিছু কথা  নারী নিরাপদ! পুরুষ নিপাট ভদ্রলোক!  নারী নির্যাতন বিচারহীন সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশে  নারীর প্রতি অপরাধ কঠোর হাতে দমনের বিকল্প নেই

মীর আব্দুল আলীম ঃ ঘরে বাইরে কোথাও কি নারীরা নিরাপদ? আমাদের এ সমাজের পুরুষেরা ঘরের বাইরে
নিপাট ভদ্রলোক!
অনেকে প্রায়ই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছুঁড়েন। মঞ্চ সেমিনারে
বলেন, ‘নারীরা মায়ের জাতি, নারী নির্যাতন করবেন না’। মাইকে গলা ফাঁটিয়ে
বক্তৃতা করেন-“বউ পেটানো লোক আমি দু‘চোখে দেখতে পারি না।” এজাতিয়
ভদ্রলোকেরা বিচার সালিশে নারী নির্যাতনকারী পুরুষ পেলে বেশ শায়েস্তাও
করেন। এ বিষয়ে নসিহত করেন; হাদিস কোরানের আলোকে পরামর্শ দেন-“বউ ঘরের
লক্ষী; কখনো বউ পেটাবেন না। আল্লাাহ নারাজ হবেন।” কিন্তু নিজ ঘরে ঢুকলেই
এদের অনেকেই এক অন্য মানুষ। বউয়ের কাছে এলেই মুখোশ খুলে যায় ওদের। আমাদের
সমাজে নেত্বদানকারী এমন পুরুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। চারপাশে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে ভুঁড়ি ভুঁড়ি। কি রাজনৈতিক, কি ডাক্তার, উকিল, জনপ্রতিনিধি,
সাংবাদিক কেউ বাদ নেই এ তালিকা থেকে। তারা বিবেক সম্পন্ন উঁচু তলার মানুষ
তবুও এ কর্মটি করেন নির্লজ্জভাবে। যারা জনগনকে সচেতন করবেন; নারী
নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবেন; তারাই যদি নির্যাতন করেন তাহলে নারী
নির্যাতন বন্ধ হবে কি করে?
এসব কারনেই পুরুষ শাসিত এ সমাজে নির্যাতনের পরিসংখ্যান এতো লম্বা যে তা
নির্নয় করা দুরুহ ব্যপার। বছরে যুনা নারী নির্যাতন হয় তার শতকরা দু’ভাগও
আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। যেগুলো আদালতে বিচারাধীন থাকে তারও সাজা হয়
ক’জনের? এসব অপরাধের ঘটনায় আদালতে মামলা হয় সবচেয়ে কম; মামলা হলে বিচার
প্রক্রিয়ার শেষে অপরাধীর দন্ড কার্যকর হওয়ার দৃষ্টান্ত আরও কম। অনেক
ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর পরিবার সামাজিক সম্মানহানির
আশঙ্কায় তা প্রকাশ করে না। একারনেই দেশে নারী নির্যাতন বাড়ছেই।
যেদিন এ লিখাটি লিখছি সেদিনের সংবাদ শিরোনাম- নিজ শ্রেণিকক্ষ থেকে হাত-পা
বাঁধা ছাত্রীকে উদ্ধার, সিঁদ কেটে যৌন হয়রানি, প্রেমপ্রস্তাবে রাজি না
হওয়ায় ছাত্রীকে লাঠি দিয়ে পেটাল বখাটে। এর ঠিক দু’দিন আগে পত্রিকায়
পড়েছি-কলেজছাত্রীর গাল কেটে দিল বখাটে, স্কুল ছাত্রীর অনৈতিক সম্পর্কেও
ছবি ফেসবুকে, বখাটের আগুনে কলেজছাত্রী দগ্ধ, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে
কিশোরীকে হত্যার চেষ্টা। কিছুতেই নারী নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না; বাড়ছে।
অবলা নারী প্রতিদিনই ধর্ষণ, গণধর্ষণ, অপহরণ, খুন, নির্যাতনের শিকার
হচ্ছে। নারীরা বাইরের চেয়ে ঘরেই বেশি নির্যাতনের শিকার হন।
নির্যাতিত নারীরা যেখানে আইনী আশ্রয় খোঁজেন সেখানেও সমস্যা। এ ব্যাপারে
একজন পুলিশ কর্মকর্তার প্রসংঙ্গ না আনলেই নয়। তিনি নারায়ণগঞ্জের এক থানার
ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঐ ওসি সাহেবের স্ত্রীরর দিন কাটতো ওপরওয়ালাকে
স্মরণ করে, যেন ঐ দিন নির্যাতনের মাত্রা একটু কম হয় এই আশায়। দোষে দুষ্ট
বললে ভুল হবে, বলতে হবে তিনি গুণে গুণান্বিত ওসি ছিলেন! অতি নিরবে বউ
পেটাতে পেটাতে তথাকথিত নারী নির্যাতন বিরোধী এই ওসির একদিন থলের বিড়াল
বের হয়ে গেল। এক রাতে থানার নিজ কক্ষে ওসি সাহেবর বউ পেটানো আসামীকে
নিজের হাতে ডান্ডা মেরে বাসায় ফিরেন। সেদিন একটু বেশীই রাগেন তিনি। নিজের
পশু চরিত্রও সামাল দিতে পারেননি। সেরাতে ঐ মহান ওসি নিজেই তাঁর প্রথম
স্ত্রীকে শুধু পিটাননি সন্তানসহ ঘর থেকেই বের করে দেন। তার অধিনস্থদের
সামনেই থানা কম্পাউন্ডে ঘটে এসব। পরদিন নারীবাদী এই ওসির বউ পেটানো মুখোশ
থানার বাউন্ডারী পেরিয়ে জনসমক্ষে ফাঁস হয়ে যায়। এই হচ্ছে আমাদের সমাজের
নারী নির্যাতনের নমুনা।
নারী নির্যাতনের সব ঘটনাই খবরই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। ইদানীং
লক্ষ্য করা যায়, নারী নির্যাতনের নুুন হাতিয়ার হিসাবে একটি ছেলে ও একটি
মেয়ের অনৈতিক সম্পর্ক একটি ক্যামেরায় ধারণ কওে ফেসবুক, টুইটর কিংবা অন্য
কোন সামাজিক মাধ্যমে দেশ-বিদেশ ছড়িয়ে দেয়। ব্যাপারটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক
এবং গর্হিত বিষয়। তাতে স্নায়ু আবেদন থাকায় এর দর্শকেরও যেন কমতি ইেন। ফলে
মোবাইল ও ইন্টারনেটের যুগে তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় দেশ-দেশান্তর। কিন্তু
এই মেয়ে, তার পরিবার এবং আত্মীয়দের অবস্থা কি আমরা ভেবে দেখেছি? তথাপি এ
বিষয়ে কথা বলার যেন কেউ নেই। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ‘গোপন ক্যামেরার
মাধ্যমে যৌন হয়রানি’র বিষয়টি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, বিষয়টি সচেতন মহলকে
উদবিঘœ কওে তুলেছে। সাধারণত স্কুল কলেজের মেয়েরাই এর শিকার বেশি হয়। উঠতি
বয়সের মেয়েরা তারা হয় কোনো প্রতিশোধের শিকার নুুবা প্রেমিকের প্রতারণার
মূল্য গুণে। পরকীয়া প্রেমে ফাঁসা নারীও এর শিকার হন।
বিচারহীনুার সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না পাওয়াই নারী
নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। নারীদের এ সমস্যা বহুদিন ধরেই
সুবিদিু; কিন্তু সমাধানের উদ্যোগ রাষ্ট্র কিংবা সমাজ কোনো পক্ষ থেকেই
জোরালো নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব, সে ক্ষেত্রে মূল
ভূমিকা পালন করে পুলিশ। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় পুলিশের এই ভূমিকা
খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। অভিযোগ আছে অজ্ঞাত
কারণে ধর্ষিতাকে সহযোগিতার বদলে তারা নানাভাবে ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে থাকে।
কেবল পুলিশ নয় সমাজপতি, গ্রাম্যমোড়লরাও এসব নির্যাতনের ঘটনার পর তা
মিমাংসা করে দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ অবস্থায় সমাজে এ ধরনের অপরাধ
ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আমরা চাই
নারীর উপর এ নির্যাতন বন্ধ হউক। নারীরা মায়ের, স্ত্রীর মর্যাদা ফিরে পাক।
আমি কাউকে অনুরোধ করবো না যে, ভেবে দেখুন। কাউকে বলবো না যে, সচেতন হোন।
কাউকে অনুনয়-বিনয় করে বলবো না- নারী নির্যাতন করবেন না, বউ পেটাবেন না।
কিছুই বলবো না আমি। মানুষ যে, সে শুধু বুঝে নেবেন। আর যে নয়- তাকে
বুঝালেও কোন কাজ হবে না জানি। তবে যারা মানুষ নন- সেই ঘৃণ্য প্রজাতিদের
সমাজ থেকে বের করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এমনকি আমি নিজেও যদি সেই রোগে
আক্রান্ত হই। ক্ষমা যেন আমারও না হয়। সমচিন বিচার যেন আমারও হয়। আমি
নারীকে তুলসী পাতা হিসেবে দেখছি না। নারীরাও অনেক দোষ করেন। তাই বলে
পেটাতে হবে কেন? একজন স্বামী হিসেবে আপনিও তো স্ত্রীর কাছে দোষ করতে
পারেন- তাই বলে কি তিনি (স্ত্রী) আপনাকে পেটাতে আসছেন? সংসার করছেন-
পরস্পরকে ভাল করে বুঝে সংসার করেন। স্বামী-স্ত্রীতে মতের মিল না হলে
আলোচনা করেন, প্রয়োজন হলে দুপক্ষের মুর”ব্বীদের নিয়ে বসে এর সুরাহা করেন।
তার পরেও সমাধান না হলে- কি আর করা, বউ পেটানো প্রথাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে
সমমঝোতার মাধ্যমে দুজন আলাদা হয়ে যান।
নারীর ক্ষমুায়ন বড়লেও নারী উন্নয়ন আজও পদে পদে বাধা। আধুনিক পৃথিবীর
ইতিহাসে নারী যে অগ্রযাত্রার সূচনা করেছিল সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর
দিকে তারই শত বছর পার হলো। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সেই ১০২ বছর আগে কিংবা
তারও প্রায় সত্তর বছর আগে নারীরা যে জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন, এখনো এই
আধুনা সভ্যযুগে আমরা মোটামুটি একই দাবি জানাতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হই।
নারীরা এখনো সমান শ্রমে সমান মজুরি পায় না, পারিবারিক জীবনে আইনি
বৈষম্যের শিকার, পারিবারিক নির্যাতনের জন্য পায় না আইনি সুরক্ষা,
কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির হাত থেকে নিস্তার পাওয়া এখনো দাবির মধ্যেই
সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। যদিও নারীর সমঅধিকার আজকে একটি স্বীকৃত নীতি জাতীয় ও
আন্তর্জাতিকভাবে। বাস্তবে তার চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। এ অবস্থা থেকে আমাদের
নারী সমাজকে উঠিয়ে আনতে হবে। নারীকে পরিচিত করে তুলতে হবে নিজ পরিচয়ে।
পরিতাপের বিষয় এ দেশের শতবর্ষী নারীও স্বামীর সংসারে পরাধীনুার শৃঙ্খল
কিছুতেই ভেদ করতে পারে না; পারে না নিজের স্বাধীনুাটুকু আদায় করে নিতে।
সংসারের বৃদ্ধ মাকে চলতে হয় শ্বশুড়-শাশুড়ি কিংবা স্বামীর অধীনে কখনো বা
সন্তানের অধীন হয়ে। জীবনের পুরটা বছর পার করলেও তার ওই সংসারে গুরুত্ব
খুব কমই পায়। আর এটাই যুগ যুগ ধরে চলছে আমাদের সমাজ সংসারে। আমাদের
অবহেলিত বঞ্চিত নারীদের আলো দেখাতে হবে, ওদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে দূর
বহুদূর।
এদেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার অপরাধগুলোকে বিশেষভাবে তদন্ত ও
বিচারের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন রয়েছে। এই আইনে যৌতুকের জন্য
সাধারণ বা গুরুতর আহতকরণসহ ধর্ষণ, ধর্ষণের প্রচেষ্টা, যৌন হয়রানী, হত্যা,
অপহরণ, দহনকারী পদার্থ দিয়ে আহত করা ইণ্যাদি প্রায় ১২ প্রকার অপরাধের
দ্রুত তদন্ত ও বিচারের জন্য ট্রাইবুনাল গঠন, ভিকটিমের জবানবন্দি
ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধকরণ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এই
আইনের অপরাধকে জামিনের অযোগ্যও ঘোষণা করা হয়। আইন আছে; আছে আদালত তবু
নারী নির্যাতন থেমে নেই। জেলায় উপজেলায় গ্রামেগঞ্জে নারী নির্যাতন চলছেতো
চলছেই। নারী নির্যাতন আগে ছিল অশিক্ষিতের কাজ এখন তা ভদ্র সমাজে ঢুঁকে
গেছে। নারীর প্রতি এসব অপরাধ কঠোর হাতে দমন ও আইন প্রয়োগব্যবস্থাকে
অধিকতর গতিশীল, দক্ষ ও কার্যকর করে তোলার বিকল্প নেই; সেই সঙ্গে নারীর
প্রতি প্রয়োজন বিশেষ মনোযোগ।
✒ লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।

এই বিভাগের আরও খবর


ফেসবুকে আমরা